সাব্বির নেওয়াজ
চরম সংকটে পড়েছে দেশের কারিগরি শিক্ষা। মানহীন হয়ে পড়ায় এ শিক্ষাকে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়নি শিক্ষার্থীদের কাছে। এ শিক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যানেও রয়েছে গোঁজামিল। সরকারিভাবে দাবি করা হয়, দেশের ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় পড়াশোনা করছে। কিন্তু বিশ্নেষকরা বলছেন, পরিসংখ্যানে কারিগরির শিক্ষার্থী হিসেবে তিন মাস ও ছয় মাস মেয়াদি বিভিন্ন শর্টকোর্স এবং ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা শিক্ষার্থীদেরও যুক্ত করা হয়- যা যৌক্তিক নয়।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের হিসাব মতে, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২ লাখের মতো। তবে আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা ও সরকারি তথ্য বিশ্নেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবে কারিগরিতে শিক্ষার্থীর হার মাত্র ৮.৪৪ শতাংশ।
দেশের সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর বেশিরভাগই এখন জরাজীর্ণ প্রায়। বেসরকারিগুলোর অবস্থাও মানসম্মত নয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাধারণ শিক্ষাধারার মতো কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নিজস্ব ভবনের সংকট তীব্র। ল্যাবরেটরি নেই, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট (বিএম) ও ভোকেশনালের শিক্ষার্থী ছাড়া বাকিদের কোনো নির্দিষ্ট পাঠ্যবই পর্যন্ত নেই। এসব কারণে উন্নত দেশ তো বটেই, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও কারিগরি শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। সেন্টার ফর এডুকেশন রিসার্চের (সিইআর) তথ্যমতে, জার্মানিতে কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা তাদের মোট শিক্ষার্থীর ৭৩ শতাংশ, জাপানে তা ৬৬ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৬৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০ শতাংশ, চীনে ৫৫ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৪৬ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে তা মাত্র ১৪ শতাংশ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাতে-কলমে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষা দিতে শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০টিরও বেশি কোর্স রয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের। যদিও শিক্ষার্থীদের মূল আগ্রহ কম্পিউটার অফিস অ্যাপ্লিকেশন, ডাটাবেজ প্রোগ্রামিং, জেনারেল ইলেকট্রিশিয়ান, সিভিল কনস্ট্রাকশন, ড্রাফটিং, ওয়েল্ডিং ও বিল্ডিং মেইনটেন্যান্সসহ হাতেগোনা মাত্র ১০-১২টি কোর্সে। বাকিগুলোতে শিক্ষার্থী খুঁজে মেলা ভার।
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক প্রকৌশলী আবদুল কুদ্দুস সরদার বলেন, কারিগরির শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম আধুনিক। সময়ে সময়েই তা আপডেট করা হয়। বর্তমানে যে কারিকুলাম রয়েছে তা ২০১৬ সালে তৈরি করা। তবে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবহারিক ল্যাবরেটরি না থাকায় শিক্ষার্থীদের শিখন ফলে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।
সরকারিভাবে কারিগরি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০২০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে ২০২০ সালের এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
জাতীয় শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছয় হাজার ৮৬৫টি। এতে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৪ জন। তবে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি শর্টকোর্সের দুই হাজার ৬০০ ট্রেনিং সেন্টারের শিক্ষার্থীদেরও যোগ করেছে। এসব ট্রেনিংয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই লাখ ৮০ হাজার ৩০১ জন। সে হিসাবে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৪৭ হাজার ৭৮৫ জন। আর কারিগরি শিক্ষায় শুধু নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ রয়েছে। তাই এসব শ্রেণির শিক্ষার্থীর সঙ্গে তুলনা করে কারিগরি শিক্ষায় ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী দেখানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী, সাধারণ শিক্ষার মতো কারিগরিতেও একাডেমিক ও সার্টিফিকেট কোর্স রয়েছে। তবে সার্টিফিকেট কোর্স খুবই স্বল্পমেয়াদে হতে পারে। আবার এর ব্যাপ্তি সর্বোচ্চ ৩৬০ ঘণ্টাব্যাপীও হতে পারে। কিন্তু সার্টিফিকেট কোর্স কোনোভাবেই মূল কারিগরি শিক্ষার মধ্যে পড়ে না। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষার অধীনে দুই হাজার ৬১৭টি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট স্কুল ও কলেজ রয়েছে। সেখানে বাংলা, ইংরেজি ছাড়া কম্পিউটার সায়েন্স, হিসাব বিজ্ঞান, ব্যাংকিং ও হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট নামে চারটি বিষয় পড়ার সুযোগ রয়েছে। এসব বিষয় সাধারণ শিক্ষার ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগেও রয়েছে, যা কোনোভাবেই কারিগরি শিক্ষার অধীনে পড়ে না। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের তিন লাখ ৩৫ হাজার ২২৫ শিক্ষার্থী বাদ দিলে কারিগরিতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় সাত লাখ ৩২ হাজার ২৫৯ জন। ওই বছর নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ছিল ৮৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮৯ জন। সে হিসাবে কারিগরিতে শিক্ষার্থীর হার দাঁড়ায় ৮.৪৪ শতাংশ।
শুধু তাই নয়, কারিগরি শিক্ষায় সরকারি হিসাবেই দিন দিন মেয়েদের সংখ্যা কমছে। অথচ সাধারণ শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে এখন ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি। বর্তমানে কারিগরিতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলোর আর উপযোগিতা নেই। যেমন- ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এখনও আছে ‘ডিপ্লোমা ইন মাইনিং’। এটি মূলত খনিজসম্পদবিষয়ক একটি কোর্স। কিন্তু দেশের সরকারি-বেসরকারি খনিজসম্পদবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো আর তাদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়টি আহ্বান করে না। এর পরও কোর্সটি চালিয়ে যাচ্ছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। আবার সারাবিশ্বেই এখন অন্যতম চাহিদা ‘ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়ের। দুই বছর আগে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এ বিষয়টি চালু করলেও এখনও শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারেনি।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. মোরাদ হোসেন মোল্লা বলেন, ‘শর্টকোর্স এবং বিজনেস ম্যানেজমেন্ট (বিএম) কলেজ দু’টিই কারিগরি শিক্ষা। একজন শিক্ষার্থী যদি কম্পিউটার শিখে একটি চাকরি পায়, তাহলে তা কেন কারিগরি শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হবে না?
দেশে সাধারণ সরকারি-বেসরকারি কলেজের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। এতে প্রতি বছর ভর্তি হয় প্রায় ১২ লাখ শিক্ষার্থী। সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সংখ্যা মাত্র ৪৯টি। সেখানে ৫০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়। এ ছাড়া ৪৬১টি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থাকলেও ভালো মানের রয়েছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টি। তাই বেশিরভাগ বেসরকারি পলিটেকনিকেই আসন শূন্য থাকে।
সাধারণ শিক্ষা থেকে এসএসসি পাস করেও কারিগরিতে আসা যায়। কিন্তু কারিগরি শিক্ষা কর্মবাজারে এখনও সাড়া ফেলতে না পারায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা এতে আকৃষ্ট হচ্ছেন না। আবার সাধারণ শিক্ষায় উচ্চমাধ্যমিক কোর্সটি দুই বছরের। অথচ কারিগরিতে ডিপ্লোমা কোর্স চার বছরের হলেও সেটা সাধারণ শিক্ষারই সমমান। কারিগরির শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে তিন বছরের কোর্স শেষের পর একে উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান দেওয়ার দাবি করে আসছেন। এ দাবি পূরণ না হওয়ায়ও শিক্ষার্থীরা এখানে আসছেন না। এ ছাড়া কারিগরি থেকে ডিপ্লোমা করে সরকারিভাবে উচ্চশিক্ষার সুযোগ কম। শুধু ডিপ্লোমা করা শিক্ষার্থীরাই ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে (ডুয়েট) পড়ার সুযোগ পান।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সরকার এখন কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর যে হিসাব দিচ্ছে, মনে হয় তা সঠিক নয়। কারণ কারিগরি শিক্ষা আর বৃত্তিমূলক শিক্ষা এক নয়। বৃত্তিমূলক শিক্ষা হচ্ছে বিক্রয় উপযোগী শিক্ষা। আর বৃত্তিমূলক শিক্ষার পরের ধাপ হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। সর্বোচ্চ ধাপ হচ্ছে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং। তবে সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলককে এক করে হিসাব করছে। এতে কারিগরির প্রকৃত সংখ্যা বোঝা যাচ্ছে না।’
এত দিন # ট্যাগ দিয়া মানবতা বাচাইছি
এখন শিক্ষা বাচাই
#i_hate_bangladesh_Education_system
#openSchoolBd
#OpenCollageBd
#Open_Education_Institude_Bd
#we_want_to_read_like_before_again